বাংলাদেশ সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহ
বাংলাদেশ সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহ আলোচনা কর।
ভূমিকা - সংবিধান একটি রাষ্ট্রের মৌলিক দলিল, যার ভিত্তিতে কোনো রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে সে-সব বিষয়ে যাবতীয় নিয়মকানুন লিপিবন্ধ থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধান সমগ্র জাতির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। পাকিস্তান যেখানে নয় বছর, ভারত তিন বছর সময় নেয়, সেখানে বাংলাদেশ মাত্র নয় মাসে (এপ্রিল ১৯৭২-ডিসেম্বর ১৯৭২) জাতিকে সংবিধান উপহার দিতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশ সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহ :
১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় পরিচ্ছেদের ২৮ থেকে ৪৪ নং অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এবং সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক মৌলিক অধিকারগুলো বলবৎ করার এখতিয়ার সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদের ১০২নং অনুচ্ছেদে বিধৃত আছে। নিম্নে বাংলাদেশ সংবিধানে বর্ণিত উল্লেখযোগ্য মৌলিক অধিকারসমূহ আলোচনা করা হলো
আইনের দৃষ্টিতে সমতা :
সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। অর্থাৎ, ধনী-গরিব, উঁচু-নীচু, জাত-কুল সকল ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে ওঠে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে, কারো প্রতি কোনো বৈষম্য করা হবে না। ফলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য প্রদর্শন না করা :
কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমানাধিকার লাভ করবে। কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাবে না।
সরকারি নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা :
বাংলাদেশ সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে। ধর্ম, গোষ্ঠী, নারী ও পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযোগ বা পদলাভে অযোগ্য হবেন না কিংবা সেক্ষেত্রে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না।
আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার :
আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী এবং কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভে যে-কোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইন ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তি হানি ঘটে।
গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ :
গ্রেফতারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেফতারের কারণ জ্ঞাপন না করে প্রহরায় আর্টিক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সাথে পরামর্শের ও তার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না। গ্রেফতারকৃত গ্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাজির করতে হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাকে তদরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাবে না।
জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধকরণ :
৩৪ অনুচ্ছেদ সকল প্রকার জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধ করেছে এবং এ বিধান কোনোভাবে লঙ্ঘিত হলে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। ফৌজদারি অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তি আইনত দণ্ড ভোগ করছে অথবা জনকল্যাণমূলক আইনে তা আবশ্যক হচ্ছে সে সকল বাধ্যতামূলক শ্রমের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না।
বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষণ :
৩৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে অপরাধ হিসেবে ফার্ম সংঘটনকালে বলবৎ আইন ভঙ্গ করার অপরাধ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা বিবেচ্য হবে না এবং অপরাধ সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইন বলে যে দণ্ড দেওয়া যেত তাকে তার অধিক বা তা থেকে বিবেচ্য ভিন্নতর দণ্ড দেওয়া যাবে না। ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনত প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচার লাভের অধিকারী।
চলাফেরার স্বাধীনতা :
৩৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বিধি-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, যে-কোনো স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশ পুনঃপ্রবেশ করার অধিকার থাকবে।
চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা :
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা দিয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক; জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতা কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের ধারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বিধি-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে।
পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা :
আইনের দ্বারা আরোপিত বিধি-নিষেধ সাপেক্ষে কোনো পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের কিংবা কারবা ব্যবসায় পরিচালনার জন্য আইনের দ্বারা কোনো যোগ্যতা নির্ধারিত হয়ে থাকলে যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যে-কোনো আইনসঙ্গত পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের এবং যে-কোনো আইনসঙ্গত কারবার বা ব্যবসায় পরিচালনার অধিকার থাকবে।
উপসংহার : বাংলাদেশ সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহ যুক্তিসঙ্গত এবং মানব চাহিদার পরিপূরক। এসব মৌলিক অধিকার ভোগ করার স্বাধীনতা না থাকলে মানবজীবন স্থবির ও নিশ্চল হয়ে পড়ত। এসব দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক সন্নিবেশন ও তা লঙ্ঘিত হলে বলবৎ করার বিধান রয়েছে।