বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি আলোচনা কর
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পদক্ষেপ আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বর্বর পাকহানাদার বাহিনীরা বাংলাদেশের মানুষকে হত্যার পাশাপাশি এ দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ফলে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতি চাঙ্গা করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এ প্রয়োজনীয়তা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয় ।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পদক্ষেপ :বিদেশি নির্ভরশীলতা হ্রাস :
বিদেশি নির্ভরশীলতা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদেশি নির্ভরশীলতা হ্রাস করার উদ্যোগ নেন। এ লক্ষ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী (১৯৭৩-৭৮) পরিকল্পনা প্রণয়ন করে বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা ৬২% থেকে ১৯৭৭-৭৮ সালের মধ্যে ২৭%-এ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন।
কর্পোরেশন গঠন :
দেশের কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্পোরেশন গঠনের উদ্যোগ নেন। এ লক্ষ্যে তিনি চারটি নতুন কর্পোরেশন গঠন করেন। এগুলো হলো বাংলাদেশ জুট কর্পোরেশন, বাংলাদেশ সুগার কর্পোরেশন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ গ্যাস অ্যান্ড অয়েল কর্পোরেশন।
শিল্প ঋণ সংস্থা ও শিল্প ব্যাংক প্রতিষ্ঠা :
বাংলাদেশের বিধ্বস্ত শিল্পকারখানা চালু এবং এর উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ক্ষমতা গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু বেশকিছু ইতিবাচক ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ নেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা গঠন এবং বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু তার শাসনামলে বিভিন্ন ব্যাংকের ১০৫০ টি শাখা স্থাপন করেন।
কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা :
বাংলাদেশের ৮৫% লোক কৃষির উপর নির্ভরশীল এবং কৃষিকে নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাই কৃষি ও কৃষককে বাঁচানোর লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর ৩৩৫টি শাখা স্থাপন করেন এই কৃষকরা সহজ শর্তে ঋণ নিয়ে কৃষিকাজে তা বিনিয়োগ করতে পারেন।
নতুন মুদ্রা চালু :
স্বাধীনতা আইনের পরও বাংলাদেশে পাকিস্তানি মুদ্রা চালু ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ব্রিটিশ সরকারের সহায়তায় বাংলাদেশের নিজস্ব মুদ্রা চালু করেন। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীকালে দেশে মুদ্রাযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে টাকশাল' গড়ে তোলা হয়।
যোগাযোগ ব্যবস্থার পুনর্গঠন :
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করতে বঙ্গবন্ধু সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করে। অল্পদিনের মধ্যেই মুজিব সরকার ৩০০টি রেলওয়ে ব্রিজ, ১৭০টি সড়ক সেতু, ৬টি বিমান বন্দর ও মংলা সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করে।
শিল্পকারখানা জাতীয়করণ :
বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য একটি পদক্ষেপ ছিল শিল্পকারখানা জাতীয়করণ । শিল্প, ব্যাংক ও বিমা জাতীয়করণ করা হয়। এক্ষেত্রে সরকার শতকরা ৮৬ ভাগ শিল্পকারখানা ও শতকরা ৮৭ ভাগ বৈদেশিক বাণিজ্য জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে আসেন।
পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচি :
গ্রাম বাংলার উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সমন্বিত পল্লি উন্নয়ন কর্মসূচি (IRDP)-এর উপর গুরুত্বারোপ করেন। বগুড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন পল্লি উন্নয়ন একাডেমি। বঙ্গবন্ধুর এসব কর্মসূচির ফলে গ্রাম বাংলায় আমূল পরিবর্তনের ছোঁয়া আসতে থাকে ।
খাইখালাসি আইন পাস :
গ্রাম বাংলার ঋণ জর্জরিত মানুষের ঋণ মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার 'থাইখালাসি 'আইন' পাস করে।। এ আইন প্রণয়নের ফলে হাজার হাজার দরিদ্র কৃষক জোতদারের নিকট থেকে জমি ফেরত পায়। এ 'খাইখালাসি আইনে' নিয়ম করা হয় যে, যদি কেউ বন্ধকী ও চুক্তি কবলা জমি ৭ বছর ভোগ করে তাহলে তার পরের বছর থেকে সে জমি মূল মালিক অর্থাৎ বন্ধকদাতা ফেরত পাবে।
নতুন শিল্পস্থাপন ও বন্ধ কারখানা চালু :
বঙ্গবন্ধু ঘোড়াশাল সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্পস্থাপন, বন্ধ শিল্পকারখানা চালুকরণসহ অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলা করার উদ্যোগ নেন। এ প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরি করে দেশকে ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার জোর প্রয়াস গ্রহণ করেন।
উপসংহার : বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন। তাই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের শাসনভার গ্রহণ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন। এ উদ্যোগের অনেক পদক্ষেপই সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছিল। কিন্তু ঘাতক কর্তৃক বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যা হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে।