১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা
গণহত্যা কী? ১৯৭১ সালের গণহত্যার বিবরণ দাও।
পাকহানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালায়। বাঙালির উপর এই নির্বিচার গণহত্যা বিশ্বের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়ের সংযোজন করে। পাকিস্তানি শাসক চক্রের নাগপাশ হতে মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলনরত বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা চিরতরে স্তব্ধ করে দেবার প্রয়াসে এ গণহত্যা চালানো হয়। কিন্তু অদম্য বাঙালি জাতি বর্বর এ গণহত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ।
গণহত্যা
'গণহত্যা'র ইংরেজি 'Genocide'. গ্রিক 'জেনোস' এবং লাতিন 'সাইড' শব্দ দুটি মিলে জেনোসাইড শব্দের সৃষ্টি। জেনোস বলতে বোঝায় জাতি। বর্তমান আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গণহত্যার অর্থ কোনো সরকার কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে জাতিগত, ধর্মীয় বা গোত্রীয় জনগণকে বিনাশ বা নির্মূল করা। ১৯৪৪ সালে 'জেনোসাইড' শব্দটি ব্যবহার করা হয়। গণহত্যা বর্তমানে আস্ত জাতিক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত, যার কোনো ক্ষমা নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার বাঙালিদের উপর গণহত্যা চালিয়ে নয় মাসে ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে। এত কম সময়ে এত বেশি মানুষ আর কোথাও হত্যা করা হয় নি।
১৯৭১ সালের গণহত্যার বিবরণ
১। ঢাকা : ঢাকা শহর মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার শিকার হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা, ইপিআর হেডকোয়ার্টার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পুরাতন ঢাকাসহ শুধু ২৫, ২৬ মার্চ ৭ হাজার লোককে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকার মোহাম্মদপুর, রায়েরবাজার, কল্যাণপুর বাস ডিপো, মিরপুরের শিয়ালবাড়ি, বাংলা কলেজ, হরিরামপুর, চিড়িয়াখানা, নুরি মসজিদ বধ্যভূমিতে হাজার হাজার লোককে এনে হত্যা করা হয়।
২। নারায়ণগঞ্জ : ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে বক্তাবলি ইউনিয়ন, আলীগঞ্জ বধ্যভূমিতে বহুলোককে হত্যা করা হয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালালেও মসজিদের ইমামও হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায় নি। ২৬ মার্চ শুক্রবার আলীগঞ্জের বধ্যভূমিতে পাগলা মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিনসহ ৬ জনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে পাকবাহিনী হত্যা করে। আলীগঞ্জের চৌকিদারের তথ্য মতে, তিনি আলীগঞ্জে একদিনে ৮০ জনকে হত্যা করে ফেলে যেতে দেখেছেন।
⇒Follow us On Google News For Latest Updates ⇐
৩। জামালপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ : মুক্তিযুদ্ধকালে জামালপুরে ১০ হাজার লোক হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। ফরিদপুরের ভাঙা থানার জানদি গ্রামে একদিনে ২৫০ জনকে পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া থানার কালিবাড়িতে ১২ অক্টোবর একদিনে ২০০ নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তা ছাড়া মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানায় পাকসেনারা একদিনে ৩৬০ জনকে হত্যা করে।৪। চট্টগ্রাম : 'দৈনিক বাংলা'র ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকবাহিনী চট্টগ্রামের প্রায় ৪০ হাজার লোককে হত্যা করে। পাহাড়তলী, ওয়ালেস কলোনি শেরশাহ কলোনি ফয়েজলেক এলাকায় উর্দুভাষী বিহারিরা প্রায় ১৩০০ বাঙালি রেলওয়ে কর্মচারী ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে। তা ছাড়া চট্টগ্রামে ৭৩ জন পুলিশ পাকবাহিনীর হত্যার শিকার হন।
৫। সিলেট : সিলেটের বালাগঞ্জ থানার আদিত্যপুরে ১৪ জুন, ১৯৭১ সালে ৬৫ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানের বহু শ্রমিককে হত্যা ও নির্যাতন করে। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানার শ্রীরামসিতে ৩১ আগস্ট প্রায় ৫০ জনকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। শমসের নগর বধ্যভূমিতে হত্যা করা ২১ জনের নাম জানা যায়।
৬। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও নাটোর : মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছিল গণহত্যার অন্যতম কেন্দ্র। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষকসহ বহু কর্মচারী, ছাত্র শহীদ হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে বাইরের বহুলোককে এনে হত্যা করা হয়। নাটোরের গোপালপুর সুগার মিলের তিনশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছে মিলের পুকুর। বর্তমানে পুকুরটির নাম 'শহীদ সাগর'।
৭। বগুড়া, রংপুর, সৈয়দপুর ও ঈশ্বরদী : মুক্তিযুদ্ধে বগুড়ায় ২৫ হাজার, রংপুরে ৬০ হাজার লোককে হত্যা করে পাকবাহিনীরা। সৈয়দপুরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন তৎকালীন এমসিএ ডা. জিফরুল হক, ডা. শাসসুল হক, ডা. বদিউজ্জামান, ডা. ইয়াকুব, প্রকৌশলিষ্ট ফজলুর রহমানসহ প্রায় ১৫০ জন। বিহারীদের সহায়তায় পাকবাহিনী ঈশ্বরদীতে ৫০০ জন লোককে হত্যা করে।
৮। চুকনগর : চুকনগর খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার অন্তর্গত। মুক্তিযুদ্ধকালে এখানেই পাকহানাদার বাহিনী সবচেয়ে বড় গণহত্যা চালায়। ২০ মে ১৯৭১ সালে এক প্লাটুন হানাদার বাহিনী হালকা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর নির্মমভাবে গুলি চালায়। এতে দশ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয় ।
৯। বরিশাল ও পিরোজপুর : স্বাধীনতার পর 'দৈনিক পূর্বদেশ' এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়। শুধু বরিশালে পাকিস্তান বাহিনী ৫০ হাজার লোককে হত্যা করে। পিরোজপুরে এ সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ হাজার। পিরোজপুরের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এসডিও আব্দুর রাজ্জাক, এসডিপিও ফায়জুর রহমান, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমানকে বালেশ্বর নদীর ঘাটে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া স্বরূপকাঠির কুড়িয়ানা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পিছনের ডোবায় ৪০০ জনকে হত্যা করে পুতে রাখা হয়।
১৯৭১ সালের গণহত্যার যে চিত্র উপরে বর্ণিত হলো তাকে খণ্ডচিত্র বলা চলে। এর চেয়ে ব্যাপক গণহত্যা হয়েছে বহু এলাকায়। বিভিন্ন প্রক্রিয়ার নির্যাতন করে পাকবাহিনীরা বাঙালিদের হত্যা করত। যেমন- হাত-পা বেঁধে গুলি করে নদী, জলাশয় বা গর্তে ফেলে রাখা ছিল সাধারণ চিত্র। এ ছাড়া অঙ্গচ্ছেদ করে গুলি করা, চোখ উপড়ে ফেলা, মাথায় আঘাত করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা, মুখ থেতলে দেওয়া, বেয়নেট ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হৃৎপিণ্ড উপড়ানো, আগুনে পুড়িয়ে, বস্তাবন্দী করে, চামড়া কেটে লবণ-মরিচ দিয়ে মারা ইত্যাদি ছিল তাদের অত্যাচারের ধরন।