মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা

মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা আলোচনা কর

মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার বর্ণনা দাও

মুজিবনগর সরকারের আত্মপ্রকাশ ঘটে ১০ এপ্রিল ১৯৭১। রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের পাশাপাশি মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ হয় এবং এ বিষয়ে জনমত গঠন করা সহজ হয়।

মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা

বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক সোনালী অধ্যায়। কারণ এ ধরনের তৎপরতার ফলে বহির্বিশ্ব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকবাহিনীর ধর্ষণ, নির্যাতন ও গণহত্যা সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। নিচে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

জনমত গঠনের চেষ্টা

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনের বিভিন্ন সমাবেশে বক্তৃতা দিয়ে জনমত গঠনের চেষ্টা করেন। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি বিশ্বের দরবারে পাকহানাদার বাহিনীর নৃশংস, ঘৃণ্য, জঘন্য বর্বরতাকে তুলে ধরেন। ফলে শান্তিপ্রিয় বিশ্বজনতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেন।

ইযযাদ সাদারল্যান্ডের সাথে সাক্ষাৎ

মুক্তিযুদ্ধকালে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান ইযযাদ সাদারল্যান্ডের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা জানান। ফলে মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটিশদের সমর্থন পাওয়া সহজ হয়।

Follow us On Google News For Latest Updates 

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হিউমের সাথে সাক্ষাৎ করেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের সমর্থন কামনা করেন এবং বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন, যা ছিল ঐ সময়ের জন্য একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত।

নিউইয়র্কের বাঙালিদের উদ্বুদ্ধ

মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে বিচারপতি চৌধুরী ২৪ মে ১৯৭১ নিউইয়র্কে যান। সেখানে তিনি বাঙালি সম্প্রদায়কে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করেন। তা ছাড়া তিনি নিউইয়র্কে জাতিসংঘে কর্মরত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন।

ব্রিটিশ পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের খবর প্রচারে উদ্বুদ্ধ

বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রেহমান সোবহান মে মাসে কলকাতা থেকে লন্ডন যান। সেখানে তিনি প্রভাবশালী পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করেন। সি গার্ডিয়ান পত্রিকায় তার দুটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং অধ্যাপক রেহমান সোবহান ব্রিটিশ পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি ফলাও করে প্রচার করতে সক্ষম হন।

বিভিন্ন দেশ সফর

বিচারপতি চৌধুরী ১৯৭১ সালের ২১-২৩ জুন হল্যান্ড, ১-৭ সেপ্টেম্বর নরওয়ে, ৭-১৩ সেপ্টেম্বর সুইডেন, ১৩-১৪ সেপ্টেম্বর ফিনল্যান্ড, ১৪-১৬ সেপ্টেম্বর ডেনমার্ক সফর করেন। সফরকালে তিনি এসব দেশের পার্লামেন্ট সদস্য, স্পিকার, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মত বিনিময় করেন। কোনো কোনো দেশের রেডিও, টেলিভিশনে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে তাতে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়ে সম্মত করাতে সক্ষম হন।

জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ

মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অংশগ্রহণের জন্য আগত বিশ্ব নেতৃত্বের সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী সাক্ষাৎ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে সংশ্লিষ্ট দেশের সমর্থন কামনা করেন। নিউইয়র্কে তিনি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনে আসেন এবং ২৯ অক্টোবর মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেন ও মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে আলোকপাত করেন।

স্বাধীনতার সংগ্রাম ব্যাখ্যা

বিচারপতি চৌধুরী স্বাধীনতার সংগ্রাম ব্যাখ্যা করার জন্য হাভার্ড, নিউইয়র্ক সিটি, কলম্বিয়া, হোফস্ট্রা ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ম্যাসাচুয়োর্টস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এম.আই.টি) ও হাভার্ড স্কুল অব ল সফর করেন। এছাড়াও তিনি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় রেডিও স্টেশন থেকে এক ঘণ্টার এক বেতার প্রোগ্রাম করে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে জনমত গঠনের চেষ্টা করেন।

মার্কিনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে অনুষ্ঠান

১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের দূতাবাস কর্তৃক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এ অনুষ্ঠানে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আমন্ত্রিত অতিথিদের নিকট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে তাদের দেশের সমর্থন কামনা করেন।

যুদ্ধ বিরতির পাল্টা তৎপরতা

পাকিস্তান ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব পাস করানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু বিচারপতি চৌধুরী পাল্টা তৎপরতা চালান, যাতে নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব পাস না হয়। তিনি সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন না করার জন্য তাদের অনুরোধ জানান।

মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির প্রতি বিশ্বব্যাপী যে সহানুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতারই ফল। ফলে বিশ্বের সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন লাভ সম্ভব হয়। মোটকথা মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতি লাভ করে এবং অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url