৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব
বিভিন্ন জাতির জীবনে কোনো কোনো নেতার ভাষণ জাতির ইতিহাস পাল্টে দেয়। বাঙালি জাতির মুক্তির বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এমনই এক ভাষণ। এ ভাষণকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদও বলা যায়। বাঙালি জাতি শত শত বছর ধরে যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে তাকে ভাষা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই শেখ মুজিব বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য করণীয় দিক নির্দেশ করেছেন। নিচে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো-
মুক্তির সনদ
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। বাঙালির বঞ্চনা, যন্ত্রণা দূরীকরণে জনগণের কর্তব্য, দাবি-দাওয়া না মানলে পাকিস্তান সরকারকে সর্বাত্মক অসহযোগিতার মাধ্যমে প্রত্যাখ্যানের নির্দেশ দেন। অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, খাজনা, ট্যাক্স প্রদান বন্ধ ঘোষণার মাধ্যমে সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে গঠিত সংসদীয় পার্টির অধীনে আনা হয়। সেনানিবাস কিংবা সচিবালয় নয় বাংলাদেশ পরিচালিত হয় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নং ধানমন্ডির রোডের বাড়ি থেকে।
মুক্তির আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর বাঙালির দীর্ঘদিনের লালিত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা পায়। এরপর তারা নেতার নির্দেশনা অনুযায়ী অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেয়। ছাত্র, জনতা, সরকারি কর্মকর্তা, বিচারপতি এমনকি বাঙালি সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারাও এ ভাষণের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়। রেডিও কর্মচারীরা এ ভাষণ ৭ মার্চ প্রচার না করায় কাজ ছেড়ে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হলে বেতারকেন্দ্র বন্ধ থাকে। পরে এ ভাষণ প্রচার করলে তারা কাজে যোগদান করে।
পত্রিকাগুলোর বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান
৭ মার্চের ভাষণ দেশের সর্বত্র নাড়া দেয়। ৭ মার্চের ভাষণের পর বেতার ও টেলিভিশন কার্যত যেমন আওয়ামী লীগের নির্দেশে চলে, তেমনি ২৫ মার্চ পাকবাহিনীর অভিযানের আগ পর্যন্ত পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের পক্ষে খবর প্রকাশ করে। ফলে মুক্তিপাগল বাংলার জনতা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রেরণা
৭ মার্চের ভাষণ বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রেরণা যোগায়। এ কারণে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র হতে এ ভাষণ বজ্রকণ্ঠ নামে প্রচারিত হয়, যা বাঙালিদেরকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করে।
বাঙালি সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধি
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। ফলে বাঙালি সামরিক বাহিনীর সদস্যরা ৭ মার্চের পর তাদের করণীয় নির্ধারণ করেন। তৎকালীন অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জিয়া বলেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের অফিসাররা ৭ মার্চের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নেন এবং সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।
⇒Follow us On Google News For Latest Updates ⇐
অসহযোগ আন্দোলন
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পরদিন থেকে দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। নেভার ঘোষণা অনুযায়ী দেশের স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, কলকারখানা সব বন্ধ হয়ে যায়। হতবিহ্বল হয়ে পাক সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালায়। এতে জনতা আরো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
হুমকি উপেক্ষা
৭ মার্চের ভাষণ পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান যখন ক্ষোভের আগুনে উত্তাল ঠিক সেই সময় অর্থাৎ ১০ মার্চ ১৯৭১ সরকার সামরিক আদেশ জারি করে। এতে বলা হয় সৈন্যদের খাদ্য সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করা হলে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে। কিন্তু বাঙালিরা সামরিক সরকারের হুমকি উপেক্ষা করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বঞ্চনা
৭ মার্চের ভাষণের শুরুতে তিনি বাঙালির প্রতি বৈষম্যের চিত্রটি তুলে ধরে বাঙালিকে নিজ অধিকারের ব্যাপারে সচেতন করেন। বাঙালিকে অর্থাৎ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে দমিয়ে রাখা সম্ভব নয় বলে যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তা পূর্ব বাংলার মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ষড়যন্ত্র
ইয়াহিয়া নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে সঠিক সময়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান না করে হীন ষড়যন্ত্রেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানিরা প্রতিটি ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে বলে বঙ্গবন্ধুর ন্যায্য কথা মেনে নেয়ার আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারে নি। ইয়াহিয়া ভুট্টোর ষড়যন্ত্রের কারণে অধিবেশন স্থগিত হয়েছে, বাঙালি ক্ষমতা লাভ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অতএব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে মোকাবিলা করার নির্দেশ বাঙালিকে দায়িত্ববান করেছে।
সরকারের প্রতি অসহযোগিতা
৩ মার্চের অধিবেশন স্থগিত করা হলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পূর্ব বাংলার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে আন্দোলন চালিয়ে যায়, ৭ই মার্চের ভাষণ সে আন্দোলনকে আরো গতিময়তা দান করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, ট্যাক্স, ব্যাংক ইত্যাদি বন্ধ রেখে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তা বাঙালিকে আরো ঐক্যবদ্ধ করেছিল।
সহিষ্ণুতা
হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে সরকারি বাহিনী গুলি চালিয়ে বহু লোক হত্যা ও আহত করেছিল। তথাপি ভাষণে তিনি সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার ও গুলি না করার অনুরোধ করে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। বাংলার হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি অবাঙালি সকলের প্রতি সকলের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে সুষ্ঠু পরিবেশে বজায় রাখতে ইঙ্গিত করেছেন।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা
ভাষণে তিনি সুস্পষ্টভাবে বাঙালিকে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আর রক্ত ঝরতে দিতে চাননি। একারণে যার যা আছে তা দিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে এবং শত্রুর প্রতি উপযুক্ত আচরণ করার নির্দেশ দিয়ে বাঙালির আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত করেছিলেন।
স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত
এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' বাক্যটি ছোট, কিন্তু অর্থ বিশাল। বাঙালি এ বাক্য ধারণ করেছে, বিশ্বাস করেছে এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। সর্বোপরি বলা যায় যে, বাঙালি জাতির ক্রান্তিকালে এক অমিয় নির্দেশ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। তাই স্বাভাবিকভাবেই এ ভাষণের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। এ অগ্নিঝরা ভাষণের সূত্র ধরেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জনের পথে আগুয়ান সফল পরিসমাপ্তি টানতে সক্ষম হয়। তাই চিরকাল প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে ধ্বনিত হবে বঙ্গবন্ধুর দরাজ কণ্ঠে উচ্চারিত মহান ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের প্রতিটি লাইন, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ ।
৭ই মার্চের ভাষণের তাৎপর্য
২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত ছিল। প্রতি মুহূর্তে পরবর্তী করণীয় কী তার নির্দেশনা এসেছে। কিন্তু ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দিয়েছেন তা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অত্যন্ত দিক নির্দেশনামূলক। একারণে ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে ইয়াহিয়া খান ঢাকা থেকে ইসলামাবাদ গিয়ে ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে বিদ্রোহের শামিল বলে উল্লেখ করেছেন । একারণে অসহযোগ আন্দোলনে ৭ মার্চের ভাষণ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ।