দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সরকারের পদক্ষেপসমূহ

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সরকারের পদক্ষেপসমূহ আলোচনা

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আলোচনা কর।

ভূমিকা : ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ একটি বিধ্বস্ত অঞ্চলে পরিণত হয়। সারাদেশের প্রশাসন, অর্থনৈতিক অবকাঠামো, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিটি ক্ষেত্রই ছিল বিপর্যস্ত। দেশের অফিস-আদালত ছিল জনশূন্য, অসংখ্য ব্রিজ ও সেতু বিধ্বস্ত হওয়ায় রেল ও সড়ক যোগাযোগ প্রতি পদে বিঘ্নিত, যান্ত্রিক জলযান বেশির ভাগই বিধ্বস্ত, কলকারখানা সৰ বন্ধ, বন্দর অচল, বহির্বাণিজ্য ছিল নিশ্চল। এমনি পরিস্থিতিতে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশের শাসনভার গ্রহণ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে শেখ মুজিবের পদক্ষেপ : যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান বেশকিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো

শরণার্থী পুনর্বাসন ও বাসগৃহ পুনর্নির্মাণ : বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে শরণার্থী পুনর্বাসন সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়গ্রহণ করেছিল। এসব শরণার্থী সংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় প্রচেষ্টায় যুদ্ধ শেষ হবার পর এসব শরণার্থী দলে দলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৪৩ লক্ষ বিধ্বস্ত বাসগৃহ পুনর্নির্মাণ করাও বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে ১৯৭৪ সাল নাগাদ ৯ লক্ষ ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব হয়।

মাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম : ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতার গ্রাম পর্যায় থেকে শুরু করে জেলা পর্যায় পর্যন্ত ত্রাণ কমিটি গঠনের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। গ্রামের আয়তন ও লোকসংখ্যার ভিত্তিতে ৫ থেকে ১০ সদস্যের “ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি” গঠন করা হয়। ত্রাণ কমিটির অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। এভাবে ইউনিয়ন, থানা ও জেলা ত্রাণ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিগুলোর মাধ্যমে সমগ্র দেশে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করার ব্যবস্থা করা হয়, যা ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

জাতীয়করণ কর্মসূচি : বঙ্গবন্ধু সরকার স্বাধীনতার পর ২৬ মার্চ ১৯৭২ সালে প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পাট, বস্ত্র, চিনিকল, ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয়করণ আইন পাস করে। ১৫ কোটি টাকা মূল্যের পরিত্যক্ত ও অনুপস্থিত মালিকদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বিমা প্রভৃতি জাতীয়করণ করা হয়। জাতীয়করণকৃত সম্পদের পূর্ব মালিকগণ প্রায় সকলেই অবাঙালি হওয়ায় বাঙালিদের পক্ষ থেকে জাতীয়করণের সমর্থনে কোনো বাধা ছিল না।

কৃষি সংস্কার : বাংলাদেশের শতকরা ৮৫ জন লোক কৃষিকাজে জড়িত। জাতীয় আয়ের অর্ধেকেরও বেশি আসত কৃষি থেকে। বঙ্গবন্ধু 'কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে' এ স্লোগান দিয়ে প্রায় ২২ লক্ষ কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসন করেছিলেন। তাদেরকে কৃষি যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য কৃষি বিষয়ক মৌলিক কাঠামো নির্মাণে সহায়তাদানের পাশাপাশি নামমাত্র মূল্যে কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ-বীজ, সার, কীটনাশক সরবরাহ করেছিল।

বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন : বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। তিনি ৫০০০ বিদ্যুৎ পোল আমদানি করেন এবং ১৯৭২ সালে ডিসেম্বরের মধ্যে ১৫০০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন করেন এবং বিদ্যুতের উৎপাদন ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে যেখানে ছিল ২০০ মেগাওয়াট সেখানে ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০০ মেগাওয়াট। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭৩ সালে দেশব্যাপী পল্লি বিদ্যুৎ কর্মসূচি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হয়।

শিক্ষার উন্নয়ন সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু মানবসম্পদের উন্নয়নে শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই শিক্ষা কমিশন গঠন এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। তবে বঙ্গবন্ধু কমিশন গঠন করে রিপোর্টের অপেক্ষায় না থেকে শিক্ষাবিস্তারের কতিপয় পদক্ষেপ গঠন করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মার্চ ১৯৭১-ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত সময়কালে ছাত্রদের সকল বকেয়া টিউশন ফি মওকুফ, শিক্ষকদের ৯ মাসের বকেয়া পরিশোধ, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পুস্তক বিতরণ ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা প্রভৃতি ।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত সকল ব্রিজ-সেতু জরুরি ভিত্তিতে পুনর্নির্মাণ শুরু হয়। ঢাকা-আরিচা সড়কের বড় বড় সড়ক সেতুসহ ৯৭টি নতুন সড়ক ও সেতু নির্মাণ করা হয়। হার্ভিজ ব্রিজসহ ধ্বংসপ্রাপ্ত অন্যান্য রেল সেতুগুলোও চালু হয়। যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ফুটে বিমান চালু, তেজগাঁও বিমানবন্দর ব্যবহার উপযোগী করার কাজ দ্রুত সম্পন্ন হয়। ঢাকার সাথে চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, লন্ডন প্রভৃতি জায়গার বিমান যোগাযোগ কার্যকর হয়।

প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা: নবীন রাষ্ট্র হিসেবে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে সরকার পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, দারিদ্র্য হ্রাস, প্রবৃদ্ধির হার ৩% থেকে ৫.৫%-এ উন্নীত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ কর হয়। খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে, ক্রমান্বয়ে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এছাড়া সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা (১৯৭৩-১৯৭৮) ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়।

প্রশাসনিক উন্নয়ন স্বাধীন বাংলাদেশের বিধ্বস্ত কাঠামোকে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনরুদ্ধার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করাকে অগ্রাধিকার দেয়। একটি প্রাদেশিক প্রশাসনিক কাঠামোকে একটি জাতীয় কেন্দ্রীয় কাঠামো হিসেবে রূপান্তরিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা কাঠামো পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে সরকার দ্রুত ১৯ জেলায় প্রশাসক ও সুপারিনটেন্ডেন্ট নিয়োগ করেন।

বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় : স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের কাজটি সহজসাধ্য ছিল না। কারণ পাকি ানের বৈরী প্রচারণায় মুসলিম বিশ্বসহ চীন বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করত। বঙ্গবন্ধুর সফল নেতৃত্বে ১৯৭৪ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র ও জাতিসংঘসহ প্রায় সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃতি লাভ করে।

উপসংহার : বঙ্গবন্ধু একজন সফল, বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা, যোগ্যতা ও বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সমাপ্তির পূর্বেই দুস্কৃতিকারীরা তাঁর জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে দেয়, যা বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url