বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বিভিন্ন দেশের সাথে
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। শাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে মনোনিবেশ করেন। এ লক্ষ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি সংস্কারের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। * বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে (১৯৭২-১৯৭৫) বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
⇒ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অবস্থান সত্ত্বেও বাস্তবতা ও বিশ্ব রাজনীতি উপলব্ধি করে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করে। ১৯৭২ সালের এপ্রিলের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ছিল দ্বিতীয় দাতাদেশ। জুন ১৯৭৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ৪৩৩ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়ে প্রথম দাতাদেশে উন্নীত হয়। এ ছাড়া খাদ্য, যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি সাহায্য সংস্থা, গ্রাম উন্নয়ন, স্বাস্থ্য প্রকল্পে মার্কিন সহযোগিতা পাওয়া যায়।
⇒ যুক্তরাজ্য
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডনে যান। সেখানে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি, বিভিন্ন সংস্থা বিশেষ করে কমনওয়েলথ ও জাতিসংঘের সদস্যভুক্তির জন্য তার সহায়তা কামনা করেন। ২৩ জুন ১৯৭২ সালে দু দিনের সরকারি সফর ঢাকা আসেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালেক ডগলাস হিউম। তিনি জাতিসংঘের সদস্যভুক্তি এবং পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ৩। ফ্রান্স : ফ্রান্স ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বীকৃতি দেয়ার আগেই বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। মার্চ ১৯৭২ সালে এমএম আবুল ফাতেহ ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। বাংলাদেশকে ১০০ ট্রাক দেয়ার ঘোষণা দিয়ে ফ্রান্স বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। পরের মাসেই জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য ফ্রান্স ৪০ লাখ ডলার সাহায্য দেয়।
⇒ অস্ট্রেলিয়া
ফ্রান্সের মতো অস্ট্রেলিয়াও স্বীকৃতির আগেই বাংলাদেশকে সাহায্যের ঘোষণা করে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এপ্রিলের শুরুতে বাংলাদেশকে ৮০০০ টন গম সাহায্য ঘোষণা করেন। ৪ এপ্রিল সাহায্য সামগ্রী নিয়ে একটি অস্ট্রেলীয় জাহাজ চালনা বন্দরে উপস্থিত হয়। ১৯৭২ সালের মে মাসে অস্ট্রেলীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিগেন হাউয়েন ঢাকা সফরে আসেন। তিনি দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণে ঐকমত্য প্রকাশ করেন।
⇒ সুইজারল্যান্ড
সুইজারল্যান্ড বাংলাদেশের সঙ্গে দূত পর্যায়ে সম্পর্ক স্থাপন করে ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসেই দেশটি ১ লক্ষ মন খাদ্যশস্য সাহায্য দেয়। ৮ জুলাই সুইজারল্যান্ডের প্রথম রাষ্ট্রদূত থিওডোর সিমিডলিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কাছে পরিচয়পত্র পেশ করেন।
⇒ পশ্চিম জার্মানি
পশ্চিম জার্মানির রাষ্ট্রদূত ঢাকায় পরিচয়পত্র পেশ করেন ১৯৭২ সালের ২৫ এপ্রিল। এর আগেই দু'দেশের মধ্যে একটি চুক্তিতে বাংলাদেশকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয়ার কথা পশ্চিম জার্মানি ঘোষণা করেন।
⇒ কানাডা
২৪ অক্টোবর ১৯৭২ সালে কানাডা দূতাবাস স্থাপন করে। এর আগে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই ২৭.৫ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয়। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ২.৮৫ কোটি ডলার সহায়তা দিলেও পরের অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ৩০ মিলিয়ন ডলার।
⇒ সোভিয়েত ইউনিয়ন
১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসেই খাদ্য সাহায্য নিয়ে প্রথম সোভিয়েত বিমান বাংলদেশে আসে। উচ্চ পর্যায়ের সোভিয়েত বিশেষজ্ঞ দলও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে সহায়তার জন্য উপস্থিত হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে দু'দেশের মধ্যে ১০ কোটি টাকা ও পণ্য বিনিময়ের বাণিজ্য চুক্তি হয় এবং ঢাকা-মস্কো টেলিযোগাযোগ স্থাপিত হয়। তা ছাড়া বিদ্যুৎ, সার খাতে সোভিয়েত সাহায্য ছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্পে সহযোগিতা করে।
⇒ পোল্যান্ড
১৯৭২ সালের ৬ নভেম্বর ৪ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে যান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ। সফরকালে পোল্যান্ডের সঙ্গে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সহযোগিতার বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সহায়তা, মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, জাহাজ ক্রয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন শিল্প ও মেশিনারি ক্রয়ের বিশেষ ঐকমত্য হয়। ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ-পোল্যান্ড যৌথ অর্থনৈতিক কমিশন গঠন, উভয় দেশ সিভিল এভিয়েশন চুক্তি স্বাক্ষরে একমত হয়।
⇒ ভারত
বঙ্গবন্ধু শাসনামলে বাংলাদেশ-ভারত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১৯৭২ সালে ২৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমিশন গঠনের মাধ্যমে নদী সংক্রান্ত বিরোধী মীমাংসা চেষ্টা করা হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় সীমান্ত চুক্তি। ১৬ মে স্বাক্ষরিত এ চুক্তিতে বেরুবাড়ির পরিবর্তে ৪টি ছিটমহল বাংলাদেশ পাবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
বঙ্গবন্ধুর স্বল্প সময়ের শাসনামলে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধু একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন। তাই তিনি তার মেধা, দক্ষতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে দূরদর্শিতার সাথে বিভিন্ন দেশের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হন, যার দরুন বাংলাদেশ অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্ব দরবারে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।