১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রকৃতি আলোচনা কর । অথবা, ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দাও।
ভূমিকা : ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে তার বাসভবনে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠন, মাত্র নয় মাসের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন, সাধারণ নির্বাচন, কমনওয়েলথ, জাতিসংঘ, ওআইসির সদস্যপদ লাভ, চীন ও সৌদি আরব ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন প্রভৃতি কর্মকাণ্ড বঙ্গবন্ধু সম্পন্ন করেছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছরে। তবুও ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে।১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিবরণ : ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় তা অত্যন্ত লোমহর্ষক ছিল। নিচে এ লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের বিবরণ উল্লেখ করা হলো
১। আক্রমণের প্রস্তুতি : ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা থেকেই মেজর ফারুকের নেতৃত্বে মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর হুদা, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, মেজর শাহরিয়ার প্রমুখ টু ফিল্ড রেজিমেন্টের কামান ও বেঙ্গল ল্যান্সারের ট্যাংক নিয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু করে। রাত ১২টা ৩০মিনিট বা ১৫ আগস্টের প্রথম প্রহরে মেজর ফারুক সব অফিসারদের হেডকোয়ার্টার স্কোয়াড্রন অফিসে সমবেত হতে নির্দেশ দেয়। এরপর মেজর ফারুক অভিযানের চূড়ান্ত ব্রিফিং দেয়। এর পূর্বপর্যন্ত অফিসার বা সৈনিকরা জানত না কি ঘটতে যাচ্ছে।
২। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের পরিকল্পনা : ঘাতকদের পরিকল্পনা ছিল বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির ৩২নং বাড়ি সরাসরি আক্রমণ করা হবে। এতে নেতৃত্ব দিবে মেজর মহিউদ্দিন, যিনি বাসাকে ঘিরে দুর্গবৃত্ত তৈরি করবে। ভেতরের বৃত্তের গ্রুপ সরাসরি বাসার উপরে আক্রমণে অংশ নিবে এবং বাহিরের বৃত্তের গ্রুপ রক্ষীবাহিনী ও বাইরের যেকোনো আক্রমণ ঠেকাবে। বাহিরের বৃত্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর নূর ও মেজর হুদাকে। এরা ২৭ নম্বর রোড, সোবহানবাগ মসজিদ, লেক ব্রিজ সংলগ্ন এরিয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিবে বলে পরিকল্পনা করা হয়।
৩। মনি ও সেৱনিয়াবাতের বাসা আক্রমণের পরিকল্পনা : বঙ্গবন্ধুর বাসায় আক্রমণের সাথে সাথে ধানমণ্ডিতে অবস্থিত শেখ ফজলুল হক মণি ও আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণের পরিকল্পনা করে ঘাতকরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেরনিয়াবাতের বাসার আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর ডালিমকে এবং শেখ ফজলুল হক মনির বাসায় আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। রিসালদার মোসলেম উদ্দিনকে।
৪। অস্ত্র নিয়ে ধানমণ্ডির দিকে যাত্রা : সেনাবাহিনীর বিপদগামী কিছু উচ্ছৃঙ্খল ও ঘাতক কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভোর চারটার সবাই যার যার অস্ত্র নিয়ে ধানমণ্ডির দিকে যাত্রা করে। সৈনিকরা শঙ্কা নিয়েই তাদের নেতাদের অনুসরণ করে। আক্রমণকারীরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে ভোর পাঁচটার মধ্যেই তিনটি টার্গেট ঘেরাও করে ফেলে ।
৫। রাষ্ট্রপতি ভবনে আক্রমণ : আনুমানিক ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে রাষ্ট্রপতি ভবনে আক্রমণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে পুলিশ গার্ডর। অবিরাম গুলি চালিয়ে সেনাদের আক্রমণকে বাধা দিতে থাকে। এ সময় বঙ্গবন্ধু নিজে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। এবং পুলিশদের ফায়ার বন্ধ করতে বলেন। এতে আক্রমণকারী সৈন্যরা বিনাবাধায় বাড়িতে ঢোকার সুযোগ পায় ।
৬। শেখ কামালকে ব্রাশ ফায়ার : বাইরে গোলাগুলি ও হৈচৈ এর আওয়াজ শুনে শেখ কামাল কী হয়েছে দেখার জন্য নিচে নামেন। আর তখনই ঘাতকরা শেখ কামালকে ব্রাশ ফায়ার করে। সাথে সাথেই গুলিতে ঝাজরা হয়ে যায় শেখ কামালের দেহ। লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। শেখ কামালকে দিয়ে ঘাতকরা শুরু করে হত্যাযজ্ঞের মিশন।
৭। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা : উপরের তলায় সিঁড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে ঘাতকদের তর্কবিতর্ক হয়। তিনি মেজর মহিউদ্দিনকে চড়া সুরে ধমক দেন। মহিউদ্দিন ঘাবড়ে যায়। মহিউদ্দিন বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে বাইরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এমন সময় মেজর হুদা এসে বঙ্গবন্ধুকে নিচে নেমে যেতে বাধ্য করেন। তিনি বারান্দার মুখে এসে দাঁড়ান। ঠিক এ সময় মেজর নূর ও মোসলেম উদ্দিন এসে উপস্থিত হয়। পর মুহূর্তেই ঘাতকের স্টেনগান থেকে এক ঝাঁক বুলেট এসে আঘাত হানে। সিঁড়ির ধাপেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
৮। বেগম মুজিব, জামাল, কামাল, রোজী ও সুলতানকে হত্যা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ঘাতকরা মানব থেকে হায়েনারূপী পশুতে পরিণত হয়েছিল। মানবহত্যার বুনো উল্লাসে মেতে ওঠে তারা। তাই বঙ্গবন্ধুর উপর গুলির শব্দ শুনে যখন বেগম মুজিব ছুটে আসেন, ঠিক তখনই ঘাতকরা দরজার মুখেই বেগম মুজিবকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে। এরপর ঘাতকরা কামরার ভেতরে ঢুকে শেখ জামাল, রোজী জামাল (সদ্য বিবাহিত হাতে মেহেদী রাঙানো) ও সুলতানা কামালকে গুলি করে হত্যা করে।
৯। শিশু রাসেলকে হত্যা : ১৫ আগস্টের রাতে ঘাতকরা পশুসুলভ আচরণের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশের জানান দেয় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র ৮ বছরের শিশু রাসেলকে হত্যা করে। ঘটনার সময় গুলির শব্দে ভয় পেয়ে শিশু রাসেল মায়ের কাছে যাবার জন্য কান্নাকাটি করে। আকুতি জানায় ঘাতকদের নিকট। এ সময় ঘাতকরা শিশু রাসেলকে তার পরিবারের সকলের লাশ দেখিয়ে তারপর তাকে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধুর দু'কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন বিধায় তারা প্রাণে বেঁচে যান।
১০। সেরনিয়াবাত ও অন্যান্যদের হত্যা : ঘাতকদের পরিকল্পনা ও টার্গেট অনুযায়ী আবদুর রব সেরনিয়াবাত তার কন্যা বেবী সেরনিয়াবাত, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু ও ভ্রাতুষ্পুত্রকে হত্যা করা হয়। সেদিনই শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
উপসংহার : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনা বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর নিকট এক ঘৃণিত ইতিহাসের নাম। ঘাতকরা শুধু স্বীয় স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা থেকে ইতিহাসের এই জঘন্যতম নৃশংস ঘটনা ঘটায়। ঘাতকদের পরিকল্পনা সেদিন সফল হলেও বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নিহত সদস্যরা বাঙালি জাতির হৃদয়ে চিরকাল থাকবে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে আর ঘাতকরা বেঁচে থাকবে ঘৃণার পাত্র হয়ে ।